মাছ থেকে বিস্কুট, চানাচুর এবং চিপস্ উদ্ভাবন
মোঃ মাসুদ রানা
আমরা মাছে ভাতে বাঙালি। মাছ বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মূল্যবান কৃষিজ পণ্য। বর্তমানে এ দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১১ শতাংশের অধিক মৎস্য সেক্টরের সাথে যুক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে এবং প্রতিবছর প্রায় ৮ লক্ষাধিক লোকের নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র বিমোচন, রপ্তানি আয় তথা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের অবদান তাৎপর্যপূর্ন। প্রাণিজ আমিষের ৬০% আসে মাছ থেকে, জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ৩.৫% এবং রপ্তানি আয়ের ১.২৩% আসে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য হতে।
বর্তমানে বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রতি বছর লক্ষ্য মাত্রা হতে অতিরিক্ত মাছ উৎপাদিত হচ্ছে। অন্যদিকে পাঙ্গাস, সিলভারকার্প ও তেলাপিয়া মাছের উৎপাদন হার বেশি কিন্তু ভোক্তাদের চাহিদা ও বাজারদর দিন দিন কমতে থাকায় চাষিরা তুলনামূলক কম মূল্যের এই সকল জাতের মাছ চাষ থেকে দিন দিন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অথচ তেলাপিয়া, পাঙ্গাস ও সিলভার কার্প মাছ গুলো পুষ্টিগুণে অনন্য কিন্তু ভোক্তাদের রুচির পরিবর্তন হওয়ায় মাছগুলোর বাজারদর কম। বিশেষ করে পাঙ্গাস ও সিলভার কার্প মাছের চাহিদা দিন দিন কমছে। এ জন্য মাছ চাষে তেমন আগ্রহ দেখায় না চাষিরা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এবং মাছ চাষিদের উৎপাদনে আগ্রহ বাড়াতে এসব মাছের বাড়তি মূল্য সংযোজনের চেষ্টা করা হচ্ছে।
তুলনামূলক কম মূল্যের মাছগুলোর প্রতি ভোক্তাদের চাহিদা বৃদ্ধি ও মূল্য সংযোজন পণ্য (ভ্যালু এডেড পণ্য) উৎপাদন করতে না পারলে তুলনামূলক কম মূল্যের কিন্তু অধিক উৎপাদনশীল মাছগুলো এক সময় চাষি পর্যায়ে পাওয়া যাবে না। এই বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ, একোয়াকালচার এ- মেরিন সায়েন্স অনুষদের গবেষণার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট গবেষকবৃন্দ তুলনামূলক কমমূল্যের এই মাছগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করে মাছের পাউডার তৈরি করে তা থেকে সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ কুকিজ ও স্ন্যাক্স যেমন- বিস্কুট, চানাচুর এবং চিপস্ উদ্ভাবন করেছেন যা বাজারে প্রাপ্ত সাধারণ বিস্কুট, চানাচুর এবং চিপস্ এর তুলনায় মানসম্পন্ন পুষ্টি উপাদান, ভিটামিন ও মিনারেল সরবরাহ করবে।
উক্ত গবেষণায় তেলাপিয়া, পাঙ্গাস, সিলভার কার্প ও টুনা মাছ থেকে ৮০-৯০% প্রোটিনযুক্ত (শুকনো ভিত্তি) মাছের গুঁড়া (ফিশ পাউডার) উৎপাদন করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়। সেসাথে মাছের দেহ থেকে ফ্যাট বা চর্বি অপসারণ করা হয় যেন তা পণ্যের জারণ (ফ্যাট অক্সিডেশন) ক্রিয়াকে প্রতিহত করে এর যথাযথ পুষ্টি মান বজায় রাখে। অতপর এই চর্বিমুক্ত ও প্রোটিনযুক্ত ফিশ পাউডার থেকে ৩০-৪০% প্রোটিনযুক্ত বিস্কুট, চানাচুর ও চিপস তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে উদ্ভাবিত পণ্যগুলো একটি লম্বা সময় মজুদ করে বা সংরক্ষিত রেখে তা থেকে নমুনা নিয়ে দেখা গেছে যে এতে অনুজীবের সংখ্যা মানব দেহে অনুমোদিত/সহনীয় মাত্রার মধ্যে ছিল এবং এদের পুষ্টির পরিমাণেরও তেমন পরিবর্তন হয়নি।
উদ্ভাবিত এ খাবারগুলো (কুকিজ ও স্ন্যাক্স) যে কোন সময়ে খাবার উপযোগী মোড়ক জাত বাজার পণ্য হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন, বাজারজাত ও সরবরাহ করা সম্ভব। এর সুফল হিসেবে চাষি পর্যায়ে ভালো বিক্রয় মূল্য পাওয়ার কারণে পাঙ্গাস, সিলভার কার্প এবং তেলাপিয়া জাতীয় তুলনামূলক কমমূল্যের মাছগুলো উৎপাদনে আগ্রহ বাড়বে। তাছাড়াও পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং প্রাণীজ আমিষ সমৃদ্ধ জনপ্রিয় এই পণ্যগুলো ছোট ছেলেমেয়েদের পুষ্টি চাহিদা পূরণ এবং গর্ভবতী নারীদের পুষ্টির সংকুলানেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এ ছাড়াও উদ্ভাবিত পণ্যগুলো রপ্তানি করে আমাদের দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সম্ভব বলে গবেষকরা মনে করেন।
আবার খাদ্যের নিরাপত্তার (ভড়ড়ফ ংধভবঃু) দিক বিবেচনা করলে সাধারণত বাজারে প্রাপ্ত কুকিজ এবং ¯œ্যাক্সগুলো মূলত ময়দা, লবণ, চিনি, মাখন, ডিম, তেল এবং কিছু অতিরিক্ত সুগন্ধি দিয়ে তৈরি করা হয়। আমাদের প্রতিদিনের নিয়মিত গ্রহণ করা আটা বা ময়দা দিয়ে তৈরি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে সাদা স্টার্চ রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়ায় যা যকৃতের উপর চাপ সৃষ্টি করে ফলস্বরূপ লিভারের দূষিত পদার্থ অপসারণ থেকে বিরত রাখে। ফলে ফ্যাটি লিভার নামক রোগের আশংকা তৈরি হয়। মাছের আমিষ ভিত্তিক খাদ্য মানব দেহের জন্য কার্বোহাইড্রেট বা শর্করার তুলনায় অধিক পুষ্টিকর এবং নিরাপদ।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭৪৫৬২৬১৫৩, ই-মেইল :ranadof.bd@gmail.com